Monday 3 November 2025
Home      All news      Contact us      RSS      English
jagonews24 - 23 days ago

বৈষম্য ও সহিংসতার বেড়াজালে কন্যাশিশু, নিরাপদ শৈশব এখনো অধরা

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সখিপুর ইউনিয়নের ১৪ বছর বয়সী মরিয়ম খাতুন পড়তো সপ্তম শ্রেণিতে। পরিবারে দুই বোন ও তিন ভাই। বাবা দিনমজুর। আর্থিক কষ্টের মধ্যেও সে স্বপ্ন দেখত পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। একটি বেসরকারি সংস্থার আয়োজনে চাইল্ড ফুটবল গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিল মরিয়ম। কিন্তু মেয়ে হওয়ায় পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের বাধার মুখে পড়ে। মরিয়মের ওপর পারিবারিক চাপ বাড়তে থাকে, এবং তার মতামত দেওয়ার সুযোগও থাকে না। একপর্যায়ে সামাজিক ও পারিবারিক চাপে দুরন্ত মেয়েটি বাল্যবিবাহের শিকার হয়। খেলাধুলা তো বটেই ঝরে পড়ে শিক্ষার সুযোগ থেকেও। একই জেলার শ্যামনগর উপজেলার ১৩ বছরের কিশোরী আকলিমা খাতুনের ভালো লাগতো স্কুলে যেতে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু সংসারে অভাব। তাই ওই বয়সেই তাকে বিয়ে দিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আরেকটু ভালো জীবনের সন্ধানে যশোরে পাড়ি জমায় তার পরিবার। একে একে চার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করে পরিবার। কিন্তু শেষমেষ তারও পড়ালেখা হয়নি। ১৭ বছরের আকলিমা এখন তিন বছর বয়সী আরেক শিশুর মা। ভুগছে নানা শারীরিক জটিলতায়। অপুষ্টি থেকে শুরু করে পারিবারিক নির্যাতন কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না তার জীবন থেকে। আকলিমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার যদি আর কোনো ছেলে সন্তান হয় তাহলেও তার সঙ্গে মেয়ের বৈষম্য করব না। মেয়েকে পড়ালেখা শেখাতে চাই। যাতে ওর অবস্থা আমার মতো না হয়।’ মরিয়ম বা আকলিমার গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের নানা প্রান্তে এমন অসংখ্য কন্যা শিশুই প্রতিনিয়ত বৈষম্য, সহিংসতা ও বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এই প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজে কন্যা শিশুর সঙ্গে বৈষম্য এখনো এক কঠিন বাস্তবতা। বৈষম্যের কারণেই সমাজে কন্যা শিশুদের সুরক্ষা ব্যাহত হচ্ছে, নির্যাতন থেকে হত্যার শিকার হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ‘সব শিশুরই মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়া উচিত’ শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের প্রোগ্রাম অ্যান্ড প্ল্যানিং পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সব শিশুরই মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা এখনো বৈষম্য দূর করতে পারিনি। পরিবার থেকে সমাজ কোথাও যেন তারা বৈষম্যের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ আরও পড়ুন:আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস আজকন্যাশিশুকে নিরাপদ রাখতে করণীয়৮ মাসে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার তিনি আরও বলেন, শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের হার ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। তাই কন্যা শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টিকে এখন অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৈষম্য দূর করতে পারলেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা সহজ হবে।জাহিদুল ইসলাম বলেন, সামাজিক সুরক্ষার অনিশ্চয়তা থেকে অনেক পরিবারে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। দরিদ্র পরিবার যেমন, তেমনি অনেক উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা দ্বিগুণ ২০২৩ ও ২০২৪ সালের তুলনায় কন্যাশিশুদের ওপর ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৫৭ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৯৫ জন এবং ২০২৩ সালে ২৫৫ জন। একই সময়ে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ১৮২ জন-যা গত বছরের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ জন কন্যা শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে; গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩৪ জন। অ্যাডভোকেসি ফোরামের উদ্বেগজনক চিত্র জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩৯০ জন কন্যাশিশু ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩টি ঘটনায় দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ২৯ জন ছিল প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু। এসব ঘটনার পর ১৫ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। সংস্থাটির ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান বলেন, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার এই পরিসংখ্যান গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি উদ্বেগজনক। ফোরামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্লেষিত ৮৪টি আলোচিত ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের ২০ শতাংশ মাদকাসক্ত, ২৭ শতাংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত এবং ভুক্তভোগীদের ৭২ শতাংশই শিশু বা ছাত্রী। অধিকাংশ ঘটনায় অভিযুক্তরা ছিলেন ভুক্তভোগীর আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তি। বিচারহীনতায় বাড়ছে সহিংসতা প্রাইম ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহিনা ফেরদৌসী বলেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিভিন্ন আইন থাকলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এসব আইনের প্রয়োগ কতটা কার্যকর? ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ায় দেরি, তদন্তে গাফিলতি, অপরাধীর সামাজিক প্রভাব এবং ভুক্তভোগীর পরিবারের ওপর চাপ সব মিলিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হচ্ছে। আরও পড়ুন:মা-বাবা পেলো মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া কন্যাশিশুমায়ের গর্ভ থেকেই বৈষম্যের শিকার কন্যাশিশুরাকন্যাশিশু জন্ম নিলেই পৌঁছে যাবে পুলিশের উপহার শাহিনা ফেরদৌসী বলেন, কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, পারিবারিক মূল্যবোধের পুনর্গঠন এবং ন্যায়বিচারের নিরপেক্ষ ও দ্রুত কার্যকারিতা। প্রতিটি শিশু যেন নিরাপদ শৈশব পায়, এটা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত নৈতিক দায়। ঘরেও নিরাপদ নয় কন্যাশিশু ঘরেও শিশুরা নিরাপদ নয়, বিশেষ করে যারা বস্তিতে বসবাস করেন কিংবা নিম্নআয়ের মানুষ তাদের কন্যাশিশুকে সুরক্ষা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ঢাকার কল্যাণপুর বস্তির কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, সম্প্রতি এক প্রতিবেশী ডেকে নিয়ে কয়েকটি শিশুকে নির্যাতন করেন। পরে ঘটনা জানাজানি হয়। আরও পড়ুন:অক্টোবরে নির্যাতনের শিকার ২০০ নারী ও কন্যাশিশুসেপ্টেম্বরে নির্যাতনের শিকার ১৮৬ নারী-কন্যাশিশুজুনে নির্যাতনের শিকার ২৯৭ নারী-কন্যাশিশু১০ মাসে নির্যাতনের শিকার ২৫৭৫ নারী-কন্যাশিশু: মহিলা পরিষদ এই বস্তির বাসিন্দা মিনারা জাহান লিজা বলেন, বস্তি এলাকায় মেয়ে বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখা কঠিন। বাবা-মা কাজে যায়, তারা ঘরে থাকে, গলিতে খেলে। ফলে কখন কার নির্যাতনের শিকার হয়ে যাচ্ছে, বোঝার উপায় থাকে না। তাদের নিরাপদে কোথাও রাখার জায়গা নেই। ‘সরকার ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে’ সম্প্রতি কন্যাশিশুর সুরক্ষাবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ে দ্রুত সহায়তা পৌঁছাতে আমরা কাজ করছি, যেন শিশুরা বিপদে পড়লে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সহায়তা পায়। কন্যাশিশুদের সুরক্ষায় সরকার ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, যখন মেয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তখন পুরো দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।’ জেপিআই/এসএনআর/এমএমএআর/এমএস


Latest News
Hashtags:   

বৈষম্য

 | 

সহিংসতার

 | 

বেড়াজালে

 | 

কন্যাশিশু

 | 

নিরাপদ

 | 

Sources